ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল একটি ঐতিহাসিক উপজেলা। এ উপজেলা বাংলাদেশের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সমৃদ্ধ। এখানে জন্ম গ্রহন করেন বাংলা তথা উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ মরহুম আবুল মনসুর আহমেদ ও মরহুম আবুল কালাম শামছুউদ্দিন।

তন্মধ্যে মরহুম আবুল মনসুর আহমেদ সাংবাদিকতা ও সাহিত্য রচনার পাশাপাশি রাজনীতিতেও উজ্জল। তিনি পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বাধীন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন।

ত্রিশাল ধন্য ও গর্বিত যার পরিচয়ের কারণে তিনি হলেন বাংলার জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার বাল্যকাল ও কৈশোর কেটেছে ত্রিশালে। এখানে বসবাস করার সময়ে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নির্যাতিত হয়েছেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু বিদ্রোহের কবিতা লিখে, শিকল ভাঙ্গার গান গেয়ে বাংলার মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। শুধুমাত্র ত্রিশালবাসী নয়, সমগ্র দেশবাসী নজরুলের সাহিত্য ও জীবন সংগ্রাম থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার শক্তি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নজরুল সাহিত্য ত্রিশালবাসীকে অগ্নিমন্ত্রে দিক্ষিত হতে উদ্দীপ্ত করেছে।

ত্রিশালের বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন, অনেকে শহীদ হয়েছেন, কেউবা জীবিত আছেন। নির্বাচিত জন প্রতিনিধি হিসেবে ত্রিশালে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন অধ্যাপক এনএম নজরুল ইসলাম এমএনও (ত্রিশাল-ফুলবাড়ীয়া), এ্যাডভোকেট আবুল মুনসুর আহমেদ এমপি ও স্থানীয় সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন মরহুম জৈমত আলী তৎকালীন সভাপতি থানা আওয়ামী লীগ), আঃ ছালাম তরফদার পরবর্তীতে এমপি, মরহুম ওয়াহিদুল আলম(সাধারণ সম্পাদক, তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগ), মরহুম আবুল হোসেন চেয়ারম্যান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মার্চ মাসের ৪ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সভার অনুকরণে ত্রিশাল নজরুল একাডেমীর মাঠে ত্রিশাল থানা ছাত্রলীগ ছাত্র ও গণ সমাবেশের আয়োজন করে। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন থানা ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল মতিন সরকার (সাবেক সাধারণ সম্পাদক ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সাবেক এমপি)। তিনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সভা পরিচালনা করেন তৎকালীন থানা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আঃ ওয়াদুদ সরকার। সভায় উপস্থিত ছিলেন নজরুল কলেজের তৎকালীন ভিপি সাইফুল ইসলাম বিএসসি, ছাত্রলীগ নেতা আবু তাহের তরফদারসহ অন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মরহুম জৈমত আলী ও মরহুম ওয়াহিদুল আলমকে যথাক্রমে আহবায়ক ও যুগ্ম আহবায়ক করে থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত সংগ্রাম পরিষদে আরও যারা যুক্ত ছিলেন তারা হলেন- মরহুম আঃ ছালাম তরফদার, মরহুম আবুল হোসেন চেয়ারম্যান, মরহুম তমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যান, মরহুম আঃ মতিন মাষ্টার চেয়ারম্যান, মরহুম আলাল উদ্দিন চেয়ারম্যান, মরহুম সাইদুর রহমান চেয়ারম্যান, মরহুম আশরাফ উদ্দিন চেয়ারম্যান, শহীদ আবদুর রহমান মেম্বার, আইয়ুব উদ্দিন খান, মরহুম আঃ মজিদ সেনেটারি ও মৌলভী আলতাব হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল বঙ্গবন্ধুর এ আহবানে সাড়া দিয়ে ত্রিশাল নজরুল একাডেমীর মাঠ, ধানীখোলা মিলন সমাজ মাঠ, বৈলর রহমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, কাজীর শিমলা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, ধলা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও কালীর বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠসহ ত্রিশালের বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতার প্রস্তুতি হিসেবে জনসভার আয়োজন করা হয়।

এসব জনসভায় এ্যাডভোকেট আবুল মুনসুর আহমেদ এমপি, থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি মরহুম জৈমত আলী, সাধারণ সম্পাদক মরহুম ওয়াহিদুল আলম, থানা ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুল মতিন সরকার (সাবেক সাধারণ সম্পাদক ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সাবেক এমপি) ও থানা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল ওয়াদুদ সরকারসহ অনেক নেতৃবৃন্দ অংশ গ্রহন করেন।

কোনো কোনো জনসভায় ত্রিশাল-ফুলবাড়ীয়া থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক এএনএম নজরুল ইসলাম, বিশেষ করে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জননেতা মরহুম রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া উপস্থিত থেকে স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী ভাষায় আবেগ সঞ্চারী উদ্দীপনামূলক বক্তব্য রাখতেন।

জনসভায় ত্রিশালের সর্বস্তরের জনতা নদীর বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো স্বতঃস্ফুর্তভাবে উপস্থিত হতো। তাদের হাতে রামদা, বল্লম, সুপারীর ফালা, ডামি বন্দুক, বাঁশের লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র শোভা পেতো, কন্ঠে ধ্বনিত হতো-বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, তুমি কে আমি কে? বাঙ্গালি, বাঙ্গালি, রক্ত সূর্য ওঠেছে-পূর্ব বাংলা জেগেছে, ইত্যাদি। পাশাপাশি এ্যাডভোকেট আবুল মনসুর আহমেদ এমপিও ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ত্রিশাল নজরুল একাডেমী মাঠ, ধানীখোলা মিলন সমাজ মাঠ, বৈলর রহমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, কাজীর শিমলা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, ধলা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও কালীর বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। ট্রেনিং সেন্টারে বাঁশ খেলা, লাঠি খেলা, শরীর চর্চা, ডামি বন্দুক ও ক্ষেত্র বিশেষে কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনা শিখানো হয়। এসব প্রশিক্ষণ সেন্টারে আবুল কাশেম, জিল্লুর রহমান, আবুল কাশেম-২, তোতা মিয়া, হোসেন প্রমুখ অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও ইপিআর সদস্য প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এভাবে এক সময় চলে আসে ২৫ মার্চ রাত্রের ভয়াবহ কালো রাত্র। পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন,  ইপিআর পিলখানা রাস্তার ফুটপাত, বস্তিসহ ঘুমন্ত বাঙ্গালিকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

২৫ মার্চের গণহত্যার খবর ত্রিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ স্থানীয় ছাত্রজনতা নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ দেশীয় অস্ত্রসহ ত্রিশালের রাস্তাঘাটে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবকগন ঢাকা থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য থাকা খাওয়াসহ নিরাপদ আশ্রয়ের এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। ত্রিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এলাকা থেকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, ডাল, তরকারি নগদ অর্থ সংগ্রহ করে মধুপুর, কাওরাইদ, গোলাঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী গ্রুপের জন্য প্রেরণ করে। এ ভাবে চলতে থাকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এরপর থেকেই নেতৃবৃন্দ নিরাপদ আশ্রয় ও ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গমন করেন।

বি.দ্র. লেখাটি লেখকের ‘ত্রিশাল উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।